Print World Header Banner

International

কেন ভারতের সাত বোন বাংলাদেশের উপরে নির্ভরশীল ?

Written by: এস এম নাহিয়ান

17-04-2025

কেন ভারতের সাত বোন বাংলাদেশের উপরে নির্ভরশীল ?

‘সেভেন সিস্টারস ভারতের একটা ল্যান্ডলকড অঞ্চল। তাদের সমুদ্রে পৌছানোর কোনো উপায় নেই। এ অঞ্চলগুলোর জন্য, আমরাই সমুদ্রের রক্ষক।” 


বাংলাদেশের কোনো রাষ্ট্রপ্রধান যে একটি বৈদিশিক সফরে যেয়ে এমন কথা বলবে, তা হয়তো বছরখানেক আগেও চিন্তা করা যেতো না। কিন্তু ঠিক এই কথাগুলোই গত ২৮শে মার্চ বলে বসলেন ডক্টর মুহম্মদ ইউনুস। তাও আবার চীন সফরে গিয়ে। 


ভারতের সাতবোনকে নিয়ে আগে অনেকেই অনেক কথা বললেও, এরকম শক্তিশালী বক্তব্য এবারই প্রথম। আর এতে যে অনেকে বেশ নড়েচড়ে বসেছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ঠিক সেজন্যই আবার নতুন করে, এই সাতবোনের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কটা আসলে ঠিক কি, সে নিয়ে আলোচনা করছি। 



সাতবোন কারা? 

এ প্রশ্নের উত্তরটা হয়তো আপনি নিমেষেই দিতে পারবেন। ভারতের উত্তরপূর্বের ৭টি রাজ্য, অরুণাচল, আসাম, মনিপুর, মেঘালয়, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড আর ত্রিপুরাকেই একসাথে সেভেন সিস্টারস বা সাতবোন নামে সম্বোধন করা হয়। 


১৯৭২ সালে জ্যোতি প্রসাদ সাইকিয়া (Jyoti Prasad Saikia) নামে ত্রিপুরার এক সাংবাদিক প্রথমবারের মতো রেডিওতে ‘সেভেনে সিস্টারস’ নামটি ব্যবহার করেন। সেখান থেকেই এই সাতবোন নামের উৎপত্তি। ভৌগলিক ভাবে কাছাকাছি অবস্থান, ভারতের মূল ভূখন্ড থেকে দূরত্ব, এবং একই ধরনের ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট থাকায়, একে বেশ সার্থক নামকরণই বলা যায়। 



যেভাবে সমীকরণে বাংলাদেশ

এখন আসল প্রশ্নটা হলো, বাংলাদেশের ঠিক কিভাবে সেভেন সিস্টারস এর সমীকরণে চলে আসে? হিসেবটা আসলে খুব সহজ। 


ল্যান্ডলকড ভৌগলিক অবস্থান 

এই সমীকরণের প্রথম বিষটিই হলো ভৌগলিক অবস্থান। সেভেন সিস্টারস এর প্রতিটি রাজ্যই পুরোপুরি ল্যান্ডলকড। অর্থাৎ এর আশে পাশে কোনো সমুদ্র নেই। আর সমুদ্র না থাকায় সমুদ্রের মাধ্যমে বাণিজ্যেরও কোনো সুযোগ নেই। 


সুতরাং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রধান যে মাধ্যম, সেখান থেকেই বিচ্ছিন্ন সেভেন সিস্টারস। আর বিষয়টি এখানেই শেষ নয়। এই সাতটি রাজ্য ছাড়াও ভারতের হিমাচল, লাদাখ, রাজস্থান, পাঞ্জাব, উত্তর প্রদেশ, বিহার, মধ্য প্রদেশের মতো অনেকগুলো ল্যান্ডলকড রাজ্য রয়েছে। কিন্তু এই প্রতিটি রাজ্যই পশ্চিম বাংলা, ওডিশা, অন্ধ্র প্রদেশ, তামিল, মহারাষ্ট্র, গুজরাট ইত্যাদি রাজ্যের মাধ্যমে সমুদ্রবাণিজ্যের সাথে সংযুক্ত। 


আর এই রাজ্যগুলো থেকে মালামাল পরিবহনের জন্য সবচেয়ে বড় সুবিধাটা হচ্ছে ট্রেন সংযোগ। পুরো ভারতজুড়ে ছড়িয়ে থাকা ট্রেন লাইনগুলোতে অসংখ্য ফ্রেইটার ট্রেন যাওয়া আসা করে। কিন্তু ভারতের রেলওয়ে ম্যাপ খেয়াল করলে দেখবেন, শুধুমাত্র একটা লাইন দিয়ে এই সাতটি রাজ্য বাকি ভারতের সাথে সংযুক্ত। আর আরেকটি রেল লাইন এসে শেষ হয় বাংলাদেশের সিলেটের কাছে। 



বিশাল দূরত্ব 

বাংলাদেশ ব্যাতীত সমুদ্রকে ছোঁয়ার জন্য সাত বোনের সবচেয়ে কাছের রাস্তা হলো, শ্যামা প্রসাদ মুখার্জী বন্দর, বা আরও সহজ করে বললে, কলকাতা বন্দর। কিন্তু পশ্চিম বঙ্গ থেকে আসাম হয়ে বাকি অঞ্চলগুলোতে স্থলপথে পৌছাতে পাড়ি দিতে হয় বিশাল দূরত্ব। 


কলকাতা বন্দর থেকে শুধু আসামের দূরত্বই ১৪০০ কিলোমিটার, ত্রিপুরার ক্ষেত্রে তা ১৬৪৫ কিলোমিটার। আর তার সাথে যুক্ত হয় এই বিশাল দূরত্ব পাড়ি দেওয়ার সময়, খরচ আর ঝুঁকি। আর এই বিশাল পথ কমিয়ে আনার সবচেয়ে ভাল উপায়টা হলো বাংলাদেশ। কারণ ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য থেকে চট্টগ্রাম বন্দরের দূরত্ব মাত্র ৭৬ কিলোমিটার। 


বাংলাদেশের কি লাভ? 

কিন্তু বাংলাদেশী বন্দর ব্যবহার করে ভারতীয় রাজ্যের জন্য পণ্য পরিবহনের বিষয়টি অনেকেই প্রথমে ভালভাবে নেন না। কিন্তু সারা বিশ্বজুড়ে ট্রানজিট-ট্রান্সশিপমেন্ট সার্ভিস মোটেও নতুন কিছু নয়। বরং সিঙ্গাপুরের মতো দেশ আজকের অবস্থানে পৌঁছেছে মূলত অন্য দেশের জাহাজগুলোকে ট্রান্সশিপমেন্ট সার্ভিস দেওয়ার মাধ্যমে। তবে এখানে বাংলাদেশের লাভ কয়েকটি মাত্রায়। 


নির্ভরশীলতা তৈরি 

ব্যবসায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, ট্রানজিট দেওয়াটাও মূলত একটা সার্ভিস বিজনেস। আর ব্যবসার অন্যতম প্রধান কৌশল হলো আগে আপনার সার্ভিসে গ্রাহককে অভ্যস্থ করা। আর এখানে গ্রাহক হলো সেভেন সিস্টারসের জনগণ। 


বাংলাদেশের মাধ্যমে পণ্য আনা-নেওয়া করলে যেই বিশাল পরিবহন খরচ সাশ্রয় হবে, তার প্রভাব অবশ্যই প্রতিটি পণ্যের দামে পড়বে। আর একটি নির্দিষ্ট সময় ধরে যখন কোনো ক্রেতা কম দামে কোনো পণ্য কিনবে, এরপরে আর সে সেই পণ্যটি বেশি দামে কিনতে চাইবে না। আরও সহজ করে বললে, বাংলাদেশের মাধ্যমে ট্রানজিটের যে সুবিধা, তাতে সাত বোনকে অভ্যস্থ করানো হবে, বাংলাদেশের প্রথম চ্যালেঞ্জ। কারণ কোনো সেবায় অভ্যস্থ করানো মানেই তার চাহিদা তৈরি করা, আর চাহিদা তৈরি মানেই, ব্যবসার সুযোগ সৃষ্টি করা। 



বাংলাদেশী পণ্য বিক্রয়ের সুযোগ 

কিন্তু ট্রানজিটের সুযোগ দিলে শুধু তাতেই থেমে থাকতে হবে এমন কোনো কারণ নেই। পরিবহন ব্যবস্থা স্থাপন হওয়া মানেই ব্যবসার সুযোগ তৈরি। আর তা লুফে নেওয়ার সুযোগ থাকবে বাংলাদেশী ব্যবসায়ীদের। পরিবহন খরচ কম বলে তুলনামূলক কম দামে বাংলাদেশী পণ্য ক্রয় করতে উদ্ভূত করাটা হবে সময়ের ব্যাপার। 


এখানে প্রভাবক হিসেবে কাজ করবে দুইটি বিষয়।  এক, সেভেন সিস্টারসের তুলনায় বাংলাদেশ শিল্প বা উৎপাদন খাতে অনেকটাই আগানো। দুই, বাংলাদেশে একাধিক নদী-বন্দর থাকায় পুনঃরপ্তানির ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ বেশ সুবিধাজনক দামে পণ্য দিতে পারবে। অর্থাৎ সহজ বাংলায়, প্রথম থেকেই বাংলাদেশ সরকারের উচিত হবে, এই বিশাল বাজারটা ধরার লক্ষ্যে কাজ করা। 


বাংলাদেশের জন্য ট্রানজিট সুবিধা

কিন্তু বাংলাদেশী পণ্য রপ্তানির মতই প্রায় সমান গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি বিষয় নিয়ে, তেমন কেউ কথা বলে না। সেটি হলো বাংলাদেশী পণ্যের জন্য ট্রানজিট। এক্ষেত্রে প্রথম দুইটি লক্ষ্য হলো নেপাল ও ভুটান। কিন্তু তা মাত্র শুরু। 


সত্যি বলতে ভারতের মধ্যে দিয়ে নেপালের ট্রানজিট ইতোমধ্যে বাংলাদেশের আছে। কিন্তু নেপালের রেল নেটওয়ার্ক অসম্ভব দুর্বল হওয়ার কারণে রেল ট্রানজিট থাকা না থাকা প্রায় সমান কথা। এছাড়া নেপাল ভুটানের বাজারের আকারও যে খুব বড়, তেমনটিও নয়। 


এক্ষেত্রে বাংলাদেশের সবচেয়ে সম্ভাবনার যায়গাটি হলো ‘ট্রানজিট টু চীন’। কিন্তু কিছুদিন আগেও হয়তো এ চাওয়াকে অলীক কল্পনা বলে উড়িয়ে দিতে হতো। কারণ বাংলাদেশের সাথে সরাসরি চীনের সংযোগ, তাও আবার ভারতের মাটির উপর দিয়ে, এর তুলনায় যেকোনো কিছুকেই সহজ মনে হয়। 


কিন্তু বাংলাদেশ-চীনের যৌথ প্রকল্পের কারণে হয়তো সূদুর ভবিষ্যতে এ সম্ভাবনা দ্বার খুলে যেতেও পারে। আর সেটি হলে লাভবান হবে দুই দেশই। কারণ চীনের এই দিকের অঞ্চলগুলো কার্যত ল্যান্ডলকড। 


এই সমস্যা নিরসনে ‘চায়না-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডর’ প্রজেক্টে চীন বিপুল বিনিয়োগ করেছে। এর অংশ হিসেবে গোয়াদর বন্দরে পণ্য নেমে পাকিস্তানের মধ্য দিয়ে তা চলে যাবে চিনের জিনজিয়াং প্রদেশে। আর সেরকম সুযোগ চীন তিব্বত, সিচুয়ানের মতো প্রদেশগুলোর জন্য পায়, তাহলে তাতে না করার সুযোগ নেই। 



সর্বোপরি, চীনের সাথে ট্রানজিট হবে বাংলাদেশের স্বপ্নের মতো। কারণ একে তো চীনে পণ্য পরিবহনে পাশাপাশি খুলবে বাংলাদেশী পণ্য রপ্তানির রাস্তা। তার সাথে পরিবহন খরচ কমায় কমবে আমদানি পণ্যের দাম। 


শেষকথা 

সত্যি বলতে চীনে ডক্টর মুহম্মদ ইউনুসের বক্তব্যে কিন্তু সেই ইশারাটাই করা হয়েছে। চীনে গিয়ে এভাবে সেভেন সিস্টারসের কথা উল্লেখ করে, ‘Make in Bangladesh then sell it to China, sell it to other countries’ বলাটা আসলে এসবের দিকের ইঙ্গিত করে।

তবে এই স্বপ্ন বাস্তবায়নে সবার প্রথমেই লাগবে শিরদাঁড়া সোজা রেখে শক্ত পররাষ্ট্রনীতি। কারণ ভারত কখনই চাইবে না চীরশত্রু চীনের সাথে বাংলাদেশের সরাসরি সংযোগ স্থাপিত হোক। আর সেখানেই কাজে  আসবে সেভেন সিস্টারসে বাংলাদেশের অর্জিত লেভারেজ এবং কূটনৈতিক শক্তি। 

Previous Post

Next Post

Related Posts

ট্রাম্প বনাম বাইডেন: চীনের উপর শুল্ক নীতির পার্থক্য...

28-04-2025

International

ট্রাম্প বনাম বাইডেন: চীনের উপর শুল্ক নীতির পার্থক্য...

ভূমিকা চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক বিগত এক দশকে বৈশ্বিক...

Read More
ইনভেস্টমেন্ট ক্লাইমেন্ট কি? রাজনৈতিক পরিস্থিতি যেভাবে...

20-03-2025

International

ইনভেস্টমেন্ট ক্লাইমেন্ট কি? রাজনৈতিক পরিস্থিতি যেভাবে...

আজকের বিশ্বে যদি আপনার ব্যবসাকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে...

Read More
ইলন মাস্ক কিভাবে ট্রাম্প প্রশাসনে এত প্রভাবশালী

18-03-2025

International

ইলন মাস্ক কিভাবে ট্রাম্প প্রশাসনে এত প্রভাবশালী

বিশ্বের এক নম্বর ধনী ইলন মাস্কের নাম শোনে নি, এমন মানুষ...

Read More

Trending

About MAWblog

MAWblog strives to provide a platform for authors, reporters, business owners, academics, people who do writing as a hobby and concerned citizens to let their voices be heard by a wider community. Our goal is to publish contents that are in line with our core goals of promoting sustainable business practices, improving community harmony and facilitating knowledge sharing and ethical labour market practices.

We invite you to write and publish under any of our nine chosen categories and make an impact towards building a better and more sustainable future.

Sign Up for Our Weekly Fresh Newsletter