পুড়ে যাওয়া স্মৃতি
মানুষের জীবনে কিছু অনাকাঙ্খিত, অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটে যায় শুধুমাত্র অবহেলা, সচেতনতার অভাবে।
কিছু দিন আগেই বেইলী রোডে এক ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে হতাহত হয়েছে অনেক মানুষ। যারা আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন তাদের অবস্থাও অনেক আশঙ্কাজনক।
কেউ কেউ হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পেয়েছে।
এরকম অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা হরহামেশা ঘটছে,কিন্তু সেই বিবেচনায় কোনো সচেতনতা নেই।
কোনো বিল্ডিং এ নেই কোনো অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা।
নেই কোনো বাতাস নির্গমনের পথ।
আর কোনো ভবনে দাহ্য পদার্থ রাখা ঠিক নয়। বেইলী রোডে যে ভবনে অগ্নিকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে, সেই ভবনের এক পাশে অনেক সারিবদ্ধ গ্যাস সিলিন্ডার রাখা ছিলো।
এই গ্যাস সিলিন্ডারই মূলত ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের জন্য দায়ী।
যাই হোক, এই ঘটনা আমাকে একটা স্মৃতি মনে করিয়ে দিলো।
আমি যখন ৫ম শ্রেণীতে পড়ি, তখন আমার টনসিল অপরাশনের জন্য ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি থাকতে হয়েছিলো। (অপরাশনের জন্য স্কুল থেকে আগে থেকেই এক মাসের ছুটির দরখাস্ত করে রাখা হয়েছিল)।
আমি হাসপাতালের যে ওয়ার্ডে ছিলাম,শুনেছিলাম, তার পাশের ওয়ার্ডে এক দগ্ধ শিশু ভর্তি হয়েছিলো।
একদিন আমার ওয়ার্ডের রুম পরিষ্কার করার জন্য হাসপাতালের আয়া আসে।ভাবলাম, পাশের ওয়ার্ডে গিয়ে শিশুটির সাথে দেখা করে আসি।
আম্মু হাসপাতালে এসিছিলো। আম্মুকে নিয়ে পাশের ওয়ার্ডে গেলাম। দেখি ওখানে অনেক বাচ্চা বেলুন, চকোলেট নিয়ে এসেছে। জানা গেলো, যে শিশুটি দগ্ধ সেদিন তার জন্মদিন।
দেখলাম, হাসপাতালের বিছানায় এক মহিলা দগ্ধ বাচ্চাকে কোলে নিয়ে মাথা মুছে দিচ্ছে। আম্মু মহিলার কাছে গিয়ে পরিচিত হয়।
আম্মু আন্টিকে জিজ্ঞেস করে, "কীভাবে এমন হলো আপনার এতোটুকু মেয়ের সাথে?
আন্টি বলতে শুরু করলেন, " আমার মেয়ের বয়স মাত্র ৩ বছর। আজ তার ৪ বছর পূর্ণ হলো। আমাদের একটি মাত্র মেয়ে। বড় আদরের। আমি আর আমার হাজবেন্ড দুজনেই কর্মজীবি। বাচ্চাকে একা কাজের মেয়ের কাছে রেখে যাই। আমরা এপার্টমেন্টে থাকি। সেখানে অনেক বাচ্চার সাথে আমার মেয়েটা সময় কাটায়। সেদিনও আমি আর আমার হাজবেন্ড প্রতিদিনের মতোই কাজের উদ্দেশ্যে বের হই।
অবনী (আমার মেয়ে) সেদিন ছাদে অন্যান্য বাচ্চাদের সাথে খেলা করছিলো। খেলতে খেলতে একটা জায়গায় একটা দেশলাই পায়। ছোট মানুষ, না বুঝে সেটা উঠায়। দেশলাই কাঠি নিয়ে নড়াচড়া করতে গিয়ে হঠ্যাৎ আগুন ধরে যায় ।অবনী সিল্কের জামা পরে থাকায় তার জামায় দ্রুত আগুন লেগে যায়। অন্যান্য বাচ্চা ভয়ে চিৎকার করতে থাকে। ভাগ্যক্রমে সেই সময় প্রতিবেশী ভাবী ছাদে কাপড় লাড়তে আসে। অবনীর গায়ে আগুন লেগেছে দেখে তাড়াতাড়ি ট্যাংক থেকে এক বালতি পানি অবনীর গায়ে ঢেলে দেয়। আমাকে ফোন করে জানালে আমি দ্রুত বাসায় যাই। আমার ফুলের মতো মেয়েটার অর্ধেক পুড়ে গেছে।
শুধু মুখটা অক্ষত আছে। "
কথাগুলো বলতে বলতে আন্টি একটু আবেগাপ্লুত হয়ে যায়।
দেখি, অবনী তার বন্ধুদের সাথে আনন্দ নিয়ে মজা করছে। হাসছে, খেলছে। তাকে দেখে মনেই হয় না, তার জীবনে এতো বড়ো একটা ঘটনা ঘটেছিলো!
আন্টি বলেন, " আমার মেয়েটা ৭ মাস ধরে হাসপাতালে। ডাক্তার বলেছে, প্লাস্টিক সার্জারী করালে অনেক খরচ।
এখন কিছুটা সুস্থ। তবে পুরোপুরি ঠিক করতে হলে বার্ণ হাসপাতালে ট্রিটমেন্ট করানো লাগবে। ডাক্তারের সাথে কথা বলে বার্ণ হাসপাতালে শিফট করবো।
আমার কাছে একটা চকোলেট ছিলো। আম্মু আমার জন্য এনেছিলো। আম্মুকে আড়ালে নিয়ে বললাম, "এই চকোলেটটা অবনীকে দেই ? আজ তো তার জন্মদিন। "
আম্মু বললো, " আচ্ছা, ঠিক আছে, দেও।"
আমি অবনীর কাছে গেলাম এবং চকোলেট দিয়ে বললাম, " "শুভ জন্মদিন, অবনী।তুমি দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠবে ইনশাল্লাহ। "
অবনী হাসি মুখে চকোলেট নিলো।
পুড়ে যাওয়া হাতে এখনও ব্যান্ডেজ লাগানো।
বড় কষ্ট হলো।
আমরা আমাদের ওয়ার্ডে ফিরে এলাম।
পুড়ে যাওয়া স্মৃতি || সাবরিনা তাহ্সিন
একজন বই প্রেমিক। তিনি বাংলা বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন। পেশায় তিনি একজন কনটেন্ট রাইটার। ছোটবেলা থেকেই বইয়ের জন্য তার অন্যরকম ভালোলাগা ও ভালোবাসা। লেখালেখি, ছবি আঁকা, রচনা প্রতিযোগিতার অংশগ্রহণ করার মাধ্যমে অনেক পুরষ্কার প্রাপ্তি ঘটেছে। কাজের ফাঁকে সময় পেলেই তিনি বই নিয়ে বসে যান, এছাড়াও অনলাইন পত্র-পত্রিকা ,ম্যাগাজিনেও লেখালেখি করা হয়। হুমায়ূন আহমেদ তার প্রিয় লেখক। বই পড়ার পাশাপাশি তিনি কবিতা, ছোট গল্প এবং মনোমুগ্ধকর বইয়ের রিভিউ দিয়ে থাকেন।